Friday 19 December 2014

দাদুর মুখে উত্তর বঙ্গ



 প্রতিবার দেশে যাওয়ার  কয়েক মাস আগে থেকে আমার দাদার নাতি রকি (২৬) আমাকে জিগ্যেস করে, দাদু এবার এসে কোথায় বেড়াতে যাবার ইচ্ছে ? রকি ওর বারুইপুর স্কুলের প্রাক্তনীবন্ধু শুভদীপ,দেবাঞ্জন ইত্যাদীদের নিয়ে প্রায় প্রতি বছর এখানে সেখানে বেড়াতে যায় ওর ওপরে সবাই ভার দেয় বেড়ানোর স্থান পছন্দ করার যাতায়াত-থাকাখাওয়া সব ব্যবস্থা করার সুতরাং একটা ছোটখাটো প্রাইভেট ট্রাভেল এজেণ্ট হয়ে উঠছে সম্প্রতি ওখানে কোলকাতার  সিকিম মনিপাল ইউনিভারসিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এম, পাশ করে চাকরীর জন্যে নানা যায়গায় পরীক্ষা দিয়ে বেড়াচ্ছে কম্পিউটার খুঁজে সব ব্যবস্থা করে

   তাই এবার নাতিকে বলেছি উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স-গরুমারা ন্যাশনাল পার্ক সম্বন্ধে অনেক শুনেছি ওখানে যাবার ইচ্ছে কয়েক ব্ছর আগে ওরা একবার ঘুরে এসে ভালো বর্ণনা দিয়েছিল তথাস্তু!

রকি সব প্ল্যান করলো কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস শিয়ালদহ থেকে রাত সাড়ে আটটায় ছেড়েছে মালদহ ঢোকার আগে ফরাক্কা বাঁধের ওপরের সেতুটা পেরনোর সময় ফরাক্কার বাঁধ দিয়ে কেমন জল যাচ্ছে দেখার ইচ্ছে ছিল সেজন্যে মাঝরাত পর্য্যন্ত জেগে ছিলুম তবুও কিছু দেখতে পেলুম না, কোলকাতার দিকে বয়ে যাওয়ার দিকেই ছিলুম ফেরার পথে অন্য দিকে বসেও কিছু দেখা যায় নি আমাদের দলে ছিলুম মোট দশজন - ভাইপোর ফ্যামিলির জন (রকির বাবা-মা ছোট বোন রেশমী (২২, এম, পড়ছে ) এবং আমার ভাগ্নের ফ্যামিলির জনঃ ভাগ্নে বুলু ভাগ্নেবৌবুলবুলি তাদের দুই ছেলে (বুম্বা রিয়াজ - দুজনেই রেশমীর চেয়ে কিছু ছোট) ট্রেণে আমরা ছিলুম রকির ফ্যামিলির সঙ্গে, ভাগ্নে পরে রিজার্ভ করেছিল বলে পেছনের একটা কামরায় পেয়েছিল পরে শুনলুম ওদের কামরায় কয়েকজন বিহারী ( মানে অবাঙ্গালী ) তরুণ প্রায় সারারাত মদ খেয়ে জোরে জোরে কথা বলতে বলতে হৈ হুল্লোড় করতে করতে গেছে

সকালে শিলিগুড়ি পেরনোর পর জঙ্গল শুরু হোল ওখানে ট্রেন বেশ ধীর গতিতে চলছিল, কারণ বেশ কুয়াশা ছিল এবং অঞ্চলে হাতির দল রেললাইন পেরিয়ে বন থেকে সে বনে যায়, এবং ট্রেণে ধাক্কা খেয়ে জখম হয় বা প্রাণ হারায় আমাদের ভাগ্য সহায় ছিল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে স্বল্প  গতি ট্রেণে যাওয়ার সময়েই আমাদের কিছু বন্যজীব দর্শন হয়ে গেল কয়েকটা ময়ূর একটা বুনো হাতি ট্রেণের দিকে মুখ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখা গেল

ট্রেণ  নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরে প্রায় বেলা ১২ টার সময়ে নিউ ম্যাল ষ্টেশানে পৌঁছলো  রকি প্ল্যাটফর্মের বাইরে গিয়ে একটা দশজন বসার টাটা সুমো গাড়ি ভাড়া করে আমাদের তুলে মূর্তিতে West Bengal Forest Development Corporation(WBFDC)এর  বাংলো বনানীতে ওঠায় বাংলোর পেছনে বিশাল চওড়া মূর্তি নদী, কিন্তু সেই জানুয়ারী মাসে রিভারবেড শুকিয়ে মাঝখানে সরু হয়ে জল বয়ে চলেছে শুনলুম বর্ষায় নদী কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে বনানী বাংলোয় আমাদের দুজনের ঘর দোতলায় - ঘরের নাম ইন্ডং  আর ওরা দুই ফ্যামিলি নীচের ঘরে ছিল - সব ঘর ওখানকার নদীর নামে - গ্যারাটী, মূর্তি, ইত্যাদী দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রামের পর বেলা আড়াইটা নাগাদ ফরেষ্ট ডিপার্টমেণ্টের জিপসী গাড়ি করে রওয়ানা দিলুম চাপড়ামাড়ি জঙ্গল সাফারীর উদ্দেশ্যে নামটা আমি বারবার ভুলে যাচ্ছিলুম বলে নাতনী রেশমী আমাকে শিখিয়ে দিল এই বলে যে মনে কর তুমি আমাকে চড় বা চাপড় মারছো চাপড়ামাড়ি জঙ্গলের Watch Tower- গিয়ে দেখি একটা বেশ উঁচু যায়গায় টাওয়ারটা টাওয়ারে না উঠেও উঁচু ঢিবিটার  ঘাসের ওপর বসে নীচের জলাশয়ের কাছে ঘুরে বেড়ানো জীবজন্তুদের বেশ দেখা যাচ্ছে সেখানে ছিল প্রচুর বাইসন, প্রায় চল্লিশটা  হাতির একটা দল, অনেক ময়ূর, কেউ কেউ মাঝে মাঝে পেখম মেলছে অন্যান্য নানা রকমের পাখির কলতান কিন্তু ওখানে বিখ্যাত একশিঙ্গী গণ্ডার দেখার সৌভাগ্য সেদিন হয়নি

   অনেকক্ষণ খোলা যায়গায় সেই বন্য প্রাণীদের মন ভরে দেখার পর বিকেলের দিকে স্থানীয় নেপালীদের Visitor Center-এর দিকে যাওয়া আমাদের জিপসীর সামনে আরো দুটো জিপসী ছিল এক সময় মাঝপথে হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল সামনে একটা বিশাল বাইসন পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিল জিপসীর ড্রাইভার রা ফরেষ্ট গার্ডরা পাথর ছুঁড়ে চেঁচামেচি করে তাকে বনের ভেতর পাঠিয়ে দেবার পর আমরা আবার চলতে থাকি নেপালীদের Visitor Center- চা-বিস্কুট খেতে দিল, তারপর তাদের কিশোরী মেয়েদের সুন্দর নাচ দেখালো



মূর্তি তে wbfdc র বনানী




মূর্তি নদী ও ব্রিজ 



চাপ্রামারী তে   বন্য প্রাণ দর্শন 



চা বাগানে কাজ করার জন্যে ইংরেজ আমলেনেপাল, সাঁওতাল পরগণা অন্যান্য নানা যায়গা থেকে প্রচুর লোক আনা হোত যারা প্রতি বছর কাজ করার পর নেপাল বা সিকিমে ফিরে যেত, তারা আবার পরের বছর বনের পথে না এসে নদীর riverbed ধরে ফিরে আসতো সেই জন্যে সব নদীকে ইংরেজরা বলত doorway বা  ডুয়ার্স অনেক বাঙ্গালীও যেত, খাতাপত্র হিসেব লেখা কর্মীদের সুপারভাইজার হিসেবে পরে ক্রমশঃ তারা ওখানেই ব্সবাস শুরু করে সুলেখিকা তিলোত্তমা মজুমদারের লেখা একটা উপন্যাস পড়েছিলুম চা বাগানের  বিভিন্ন সমাজকে নিয়ে  তিলোত্তমা অঞ্চলের মেয়ে আমাদের তানিয়ার দাদামশাই ওখানে ডাক্তার ছিলেন, তানিয়ার মায়ের কাছে শুনলুম তিলোত্তমার বাড়ি ছিল ওঁদের হাসিমারা গ্রামে বাড়ির খুব কাছেই তিলোত্তমা খুব ওঁদের বাড়িতে যেতেন প্রখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদারও ডুয়ার্সের চা বাগান থেকে এসেছেন  
রাতে খাবারের  জন্যে বলে দেওয়া হোল নুন কম দিতে এবং ঝাল না দিয়ে রাঁধতে আমাদের জন্যে আমাদের খাবার আলাদা তুলে তা
রপর অন্যদের জন্যে যত খুশি নুন-ঝাল দিতে পারে দিক
পরদিন সকালে  আমরামূর্তির সেই বিরাট চওড়া riverbed- একটু বেড়িয়েছি নদীরপরপারে একটু দূরে গরুমারা জঙ্গল  নাতি  তিনজন প্যান্ট গুটিয়ে নদীর ওপারে বেড়াতে গেল, খানিক দূরে একটা সেতু দেখা গেল, তার ওপর প্রচুর লোক্জন বেড়াতে গেছে, গরুমারা জঙ্গল দেখছে নাতনী রেশমীও কোন কিছুতে ভাইদের থেকে পিছপা নয়, সেও তার পাজামা হাঁটু পর্য্যন্ত তুলে নদী পেরিয়ে তাদের সঙ্গে গেল আমরা দুই বুড়োবুড়ি নদীর পাড়ে বনানীর চেয়ারে বসে ওদের দেখেছি

  পরদিন ১৫ জানুয়ারী আমাদের গন্তব্য কালিপুর ইকো ভিলেজ গিয়ে দেখি ওটা যাদবপুর চা বাগানের সামনে চা বাগানের মালিক আমাদের কোলকাতার যাদবপুর অঞ্চলের অধিবাসী , তাই চা বাগানের নাম দিয়েছেন যাদবপুর টি গার্ডেন  কালিপুর ইকো ভিলেজের কটেজগুলো ছোট, কিন্তূ খুব সুন্দর করে তৈরী, উঁচু উঁচু খুঁটির (silt-এর) ওপর (যেমন দেখেছিলুম আলাস্কার Barrow শহরে, সুন্দরবনের নীচু জমিতে stilt-এর ওপর কটেজ

মোষের গাড়িতে রকি 

মেদলা ওয়াচ টাওয়ার 





কালিপুর এর কটেজ গুলোর নাম সাঁওতালী ভাষায়ঃ ঢাড্ডা, মালসা, চেপটি, আর মধুয়া পাঁচটা কটেজের মাঝেরটা নীচে খাবার তৈরী করে ওখানে রাখা, তারপর ওখান থেকে দুদিকের কটেজে সার্ভ করে কটেজগুলোর মধ্যে ওপর থেকেই যাতায়াতের পথ আছে, ঘরের বাইরে থেকেনীচে নামতে হয় না কটেজগুলোর পেছনে বেশ উঁচু মোটা  কাঁটা তারের বেড়া, তার ওপারে গরুমারা জঙ্গল, বেশ ঘন জঙ্গল তাই আশা ছিল রাতে হয়ত বাঘের ডাক শুনতে পাবো সে আশা পুরণ  হয় নিকটেজের পেছনদিকে  গরুমারা জঙ্গল আর সামনে  একটা ছোট পুকুর তার ধারে জলের কাছে বেশ বড় বড় ঘাস ছিল, একটা মোষ এসে জলের ধার ধরে ঘাস খাচ্ছিল, আর তার পায়ে যে সব মাছি বা পোকা বসছিল একটা সাদা গাংচিলের মত পাখি তা খাবার জন্যে মোষটার পেছনে পেছনে সামান্য উড়তে উড়তে চলেছে তার পরে কালিপুর গ্রামের চাষিদের কিছু চাষের জমি ছিল দুপুরবেলা WBFDC কর্মীদের সুস্বাদু রান্না খাবার পর বিকেলে মোষের গাড়ি চেপে যাওয়া হোল মেদলা ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে,নাতি-নাতনী সব প্রথম মোষের গাড়ি চেপে খুব উপভোগ করেছে আমি গেঁয়ো ভুত, ছোট বেলায় অনেক মোষের গাড়ি চেপেছি মেদলা টাওয়ারের গোড়ায় গিয়ে প্রথমেই চোখে পড়লো একটু দূরে নীচু যায়গায় বেশ বড় নুনের থামে দুটো গণ্ডার নুন চেটে চলেছে সামনে মুরতি নদীর বিরাট


চওড়া  riverbed খানিক পরে দেখি মুরতি নদীর ওপার থেকে টে গণ্ডার ধীর পদক্ষেপে নদী পেরিয়ে এদিকে আসছে নুন খাবার জন্যে দেখে মনে হোল একটা বাচ্চা গণ্ডার (young adult) আর তার সামনে-পেছনে বাবা-মা, অথবা দুটো বাচ্চা তাদের বাবার সঙ্গে আসছে রকি সেই procession টার ভালো একটা ছবি তুললো



ওখানে কয়েকটা ময়ূরও পেখম মেলে আমাদের দর্শন দিল (যেমন দেখেছি চাপড়ামারীতে), গাছেও ছিল তাছাড়া একটা বাচ্চা হরিণ একটা বেঁজী দেখা গেল কয়েক ঘণ্টা পরে সেই মোষের গাড়ি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে এল আমাদের কটেজে  ।

রাত আটটার সময়ে সাঁওতালী আখড়াতে আদিবাসী মেয়েদের নাচের অনুষ্ঠান হোলশেষের দিকে আমার ভাগ্নী জেবু (রকি-রেশমীর মা) ওদের ষ্টেজে উঠে গিয়ে ওদের জড়িয়ে একটু ঘুরলো  সেই নিয়ে আমাদের দলের খুব হাসাহাসি হোল সত্যজিৎ রায়ের আগন্তুকসিনেমাতে মমতাশংকর এর এরকম একটা নাচের কথা মনে পড়লো তারপর কটেজে ফিরে ডিনার দেশী মুরগীর মাংস খুব ভালো রান্না হয়েছিল

   পরের দিন সকালে প্রচণ্ড কুয়াশার মাঝে আমাদের হাতি সাফারী হাতিগুলোয় বসার কোন আসন ছিল না, মাহুতের পেছনে মাহুতকে ধরে বেশ কষ্ট করে মোটা হাতির দুদিকে পা ঝুলিয়ে (ঘোড়ায় চড়ার মতবসা  হাতিগুলোর নাম ছিল চন্দন, রামী, কিরণরাজ একটা হাতিতে রেশমী আমাকে নিয়ে বসলো, যাতে আমি ওর কোমর জড়িয়ে ধরে বসতে পারি আমাকে নিয়ে সব সময় খুব protective wayতে চলে কোন ভীড়ের যায়গায় গেলে আমার হাত ধরে চলে, যাতে আমি হারিয়ে না যাই বা কোন বিপদে না পড়ি ওর ভাইদের ওপর ওর আস্থা নেই যে এই ৭৮ বছরের দাদুর ওপর ওরা ঠিকঠাক নজর রাখতে পারবে কি নাআর একটা হাতিতে ওরা তিন ভাই বসে গেল

কালিপুর ইকো ভিলেজ এ আমাদের কটেজ 

হাতির পীঠে ছড়ে  রিয়াজ-রকি -বুম্বা









হাতিগুলো খুব লম্বা লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে গেল সারাপথ কিছুই দেখা গেল না, শেষের দিকে আমাদের পথের কাছেই একটা বিশাল সাইজের বাইসন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখা গেল মাহুতকেজিগ্যেস করলুম আমাদের দিকে তেড়ে আসবে না?  মাহুত বললো না, আমরা হাতির পিঠে আছি, জানে আমাদের কিছু করলে হাতি ওকে শায়েস্তা করবে কি ভাবে জানি না, হয়ত শুঁড় দিয়ে শিং ধরে লাথি কসাবে 
   হাতি সাফারী থেকে ফিরে ব্রেকফাষ্ট সেরে পরবর্তী গন্তব্য ভুটান সীমান্তের কাছে  Paren-  যাবার তোড়জোড় সকাল ১০টায় বেরিয়ে প্যারেনের পথ ধরা  লাটাগুড়ি খুনিয়া মোড় পেরোনোর পর শুরু হোল খারাপ রাস্তা  খুনিয়া মোড়টার নাম হয়েছিল ওখানে কয়েক বছর আগে কিছু পাড়াতুতো দ্বন্দে কেউ খুন হয়েছিল বলে ঘন্টা দুই পরে আমরা WBFDC- Paren লজে উঠি একটা ঘেরা যায়গার চারদিকে কয়েকটা আলাদা আলাদা কুঠি , মাঝে সুন্দর ছোট বাগান বাইরে লাগোয়া এলাচ গাছের বাগান পেছনে ঘন জঙ্গল বেশ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ, নানারকম পাখির গুঞ্জন
গেট থেকে বেরিয়ে খোয়া বিছানো রাস্তা ধরে বেড়িয়ে আসা যায় লাঞ্চের পর নাতি নাতনীরা বেরিয়ে পড়লো  পরেওদের কাছে শুনলুম আসার পথে রাস্তার ধারে রাস্তা থেকে একটু নীচুতে যে একটা  ছোট বাড়ির  সামনে একটা ছোট মাঠ দেখে এসেছিলুম সেখানে কয়য়েটা বাচ্চা খেলা করছিল একজন অল্প বয়সী মা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল রেশমী রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আদর করেছে তার মা খুব খুশি হয়ে রেশমীর সঙ্গে কথা বলেছে - আমরা কোথা থেকে গেছি সেই সব জিগ্যেস করেছে, ইত্যাদী

wbfdc র  paren cottage

paren থেকে  প্রকৃতি 

কটেজ এর উপর বসে থাকা সুন্দর একটা পাখি 

গ্রামের বাচ্চা কে  কোলে নিয়ে রেশমির ছবি তোলা

Paren- সে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন একটু ভালো রাস্তা পেয়ে পৌঁছলুম ভারত-ভুটান সীমান্তের শেষ জনপদ বিন্দুতেসেখানে একটা বেশ উঁচু পাহাড়ী নদী থেকে জলপ্রপাত পড়ছে তার ওপর ভারত-ভুটান বাউণ্ডারী গেট তার পরে একটা  উঁচু সেতু বিন্দুতে কয়েকটা  খাবারের দোকান আছে শুনলুম ওখানকার মোমো নাকি বিখ্যাত এটার কথা বাণী বসু বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কোন লেখাতে পড়েছিলুম সেটা কি জিনিষ দেখার জন্যে একটা দোকানে খোঁজ নিয়ে দেখে জিনিষটা খুব একটা পছন্দ হোলনাদেখাচ্ছে যেন একটা ময়দার লুচি বেলে তার মধ্যে কিছু মিষ্টি বা সব্জির পুর ভরে ষ্টীমে সেদ্ধ করা  অজানা যায়গায় রকম খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে মুসকিল হবে  নদীর পাড়ে বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই পড়ে  আছে কিছু কিছু তরুণ-তরুণী সেই সব চাঁইএর ওপর উঠে ছবি তুলছে নদীর ওপারে ভুটানের সীমান্তে বেশ উঁচু পাহাড় তার ওপর ঘন বনানী   







বিন্দু থেকে ভুতা এর গ্নরাম




bindu barrage , এদিকে ভারত ওদিকে ভুটান




বিন্দুতে কিছুক্ষণ সেই প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করে আমরা রওয়ানা হলুম জলদাপাড়ার উদ্দেশ্যে   বড় জলঢাকা নদীর পশ্চিমে গরুমারা জঙ্গল পূবে বড় ব্নানী জলদাপাড়া জঙ্গল ওখানে বক্সা টাইগার প্রকল্প রাজাভাত্খাওয়ার মিউজিয়াম, ইত্যাদী আছে আমাদের বুকিং ছিল হলং লজে সুনীল গাঙ্গুলীর একটা গল্পে এই হলং লজটার নাম পড়েছি এখানে নাকি নানা সময়ে সিনেমা শুটিং হয় লজের সামনে একটা ছোট নদী বা খাল আছে, তার পাড়ে পাথরের খাড়াই দেওয়াল, যাতে বন্য প্রাণীরা না লজের চত্তরে আসতে পারে তবে প্রাণীরা আসতে চাইলে একটু দূরে গিয়ে নদী পেরিয়ে আসতে পারবে নদীর ওপারে হলং লজের সামনেই salt pit আছে বিকেলের দিকে তার জন্যে চলে এল একটা বাইসনের দল, আর চারদিক থেকেময়ূরের ডাক আছে সারাক্ষণ রাতে লজের সার্চ লাইট ফেলে একটা সম্বর হরিণ একটা গণ্ডার দেখা পাওয়া গেল


হলং বাংলো সামনে বাইসনের দল


হলং লজ
পরদিন সকাল থেকে হাতির সাফারী শুরু হয় হলং লজের গেটের বাইরে থেকে আমি সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখি অন্যান্য যায়গা থেকে এসে অনেক লোক হাতি সাফারী নিচ্ছে একটা হাতির দলে একটা বাচ্চা হাতি তার মায়ের সঙ্গে এসে চার দিকে খেলা করে বেড়াচ্ছে, তার মায়ের কাছে অন্য হাতির কাছে গিয়ে গা ঘসছে মাঝে মাঝে আমাদের কাছে এসে ছোট্ট শুঁড় তুলে খেলা করছে আমি তার শুঁড়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলুম সে আমার ক্যামেরা শুঁড় দিয়ে বুলিয়ে দিল, তারপর আমার হাতেও তার শুঁড় বুলিয়ে দিল পরে শুনলুম নাকি  কোন একজন লোককে জোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল দেখলুম আমি ওকে আদর করেছি, অন্য লোকের কাছে গিয়ে যখন একটু খেলা করতে চেয়েছে তারা ওকে তাড়িয়ে দিচ্ছে বা এড়ানোর চেষ্টা করছে  তাই আমার মনে হয় যাকে ধাক্কা মেরেছিল সে ওর প্রতি কোন রকম বিরূপতা দেখিয়েছিল যাই হোক, নির্দ্ধারিত হাতি এসে পৌঁছলে আমাদের যাবার ডাক এল এই হাতি চাপার জন্যে একটা উঁচু প্ল্যাট্ফর্ম বসার জন্যে ভালো ব্যবস্থা ভালো ছিলএকটা চারকোনা বেড়া বিছানা ছিল এই হাতিগুলোর  সঙ্গে কোন বাচ্চা ছিল না এরা তিন বোন নাম বড় দময়ন্তী, মেজো অনুসুয়া, আর ছোট বোন প্রিয়দর্শিনী এদের মৃত মায়ের নাম ছিল প্রিয়ংবদা  আমি জিগ্যেস করলুম এদের বাবা কে বা কারা? মাহুত বললো, “জানিনা, এদেরজঙ্গলেছেড়েদেওয়াহয়, বন্যহাতিদেরকেউএদেরবাবা আমি-রেশমী আর জেবু একটা হাতিতে বোধহয় অনুসুয়ার পিঠে চেপেছিলুমঅপর্ণা , বুম্বা-রিয়াজও তাদেরমা  বুলবুলি অন্য একটা হাতির  পিঠে ছড়েছিল


অপর্ণা কিছুতেই যেতে চাচ্ছিলনা , বুম্বা-রিয়াজও তাদেরমা   বুলবুলি জোরকরেধরেনিয়েওদেরহাতিরপিঠেচাপিয়েছেরকি ,আমার ভাইপো ফজলু আর আমার  ভাগ্না বুলু আর একটা  হাতিতে চেপেছিল, তাইরকিওর দাদিমার সুন্দরএকটা ছবি তুলেছিল হাতির পিঠে পা ঝুলিয়ে বসাসেটা রকি পরে ফেসবুকেপাঠাতে এখানে আমাদের ছেলেমেয়েও নাতি-নাতনীরা দেখেখুব enjoy করেছেহাতির দল কয়েকটা জলাশয় বা খালের জলের ওপর দিয়ে গিয়ে এক টা জঙ্গলে ঢুকতে দেখা গেল প্রায় হাত দশেক দূরে ঘাসের মধ্যে একটা এক শিঙ্গী গণ্ডার একা দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে এত কাছে থেকে একটা বন্য গণ্ডার দেখতে পাবো ভাবতে পারিনি সেটার ছবি রকি আর রেশমি তাদের কামেরা দিয়ে খুব সুন্দর তুলেছিল মাহুতদের হাতি চালানোর টেকনিকটা বেশ মজারলা গলো ষ্টীয়ারিং হোল ওদের কান আর মাহুত রা দুই পা দিয়ে হাতি গুলর দিক নির্ধারণ করছিল ডানদিকে যাবার দরকার হলে মাহুত ডান পা দিয়ে হাতির ডান কানচেপে ধরছেবামদিকেজন্যে বামকান কিছু বড়গাছের গায়ে কিছু লতাগুল্ম থাকলে আমাদেরহাতিএকটুদাঁড়িয়ে সেগুলো মুখেপুরে চিবুতে চিবুতে চলতেথাকেসব লতা খায়না দেখলুম, ওদের  পছন্দের  লতা হতে হবে এক যায়গায় মাহুত আমাদের কথা বলতে  ইঙ্গিতে নিষেধ করে খুব নিঃশব্দে গিয়ে একটু দুরে একটা ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা কালো বন্য বেড়াল শুয়ে আছে দেখালো এভাবে এই হাতি সাফারীটা খুব উপভোগ্য হয়েছিল




                                                

হলং এ হাতি সাফারি






নাতি নাতনি দের সাথে আমরা

সাফারী সেরে ব্রেকফাষ্ট হোলহলং- ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের এক রেষ্টুরেণ্ট ম্যানেজার বাচ্চু রহমান আমাদের খুব যত্ন করে ব্রেকফাষ্ট খাওয়ালেন তারপর আমাদের ভাড়া করা গাড়িতে চেপে রাজাভাত খাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়াম টা দেখা হোল মিউজিয়ামের দেওয়ালে বেশ বড় করে graffiti  ছবি দেওয়া আছে তাতে তাঁবু ও অনেক লোক আছে আমাদের ড্রাইভার ওটার গপ্পো শোনালো যখন কুচবিহার আলাদা একটা রাজ্য ছিল, তখন ভুটানের এক শক্তিশালী রাজা কুচবিহারকে আক্রমন করে কুচরাজাকে পরাজিত করেন তারপর ভুটানের রাজা নিজে এসে কুচরাজাকে বলেন তোমরা বাঙ্গালীরা নাকি খুবভালো মাছ-ভাত রান্না খাওআমাকে সেরকম ভালো মাছ-ভাত রান্না করে খাওয়াও এখানে সুতরাং কুচরাজা তাঁর রাধুনীকে আদেশ করে ভালো করে মাছ-ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন তাঁবুর বাইরে চেয়ার টেবিলেসেই খাওয়ানোর দৃশ্য গ্রাফিটি ছবি করে দেখানো হয়েছেভুটানরাজ সেই মাছ-ভাত খেয়ে খুব পরিতৃপ্ত হয়ে কুচরাজকে তাঁর জয় করা রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে গেলেনসেই থেকেই এই অঞ্চলটার নাম হয়েছেরাজাভাতখাওয়াঅতঃপর আমাদের গন্তব্য মিউজিয়ামের খানিক দূর পেছনে Buxa Jungle Lodge    সেখানে যেযা র নির্দ্ধারিত ঘরে মাল পত্র নামিয়ে লাঞ্চ খেয়ে গাড়িতে করে শুকিয়ে যাওয়া বিরাট চওড়া জয়ন্তী নদী পেরিয়ে জয়ন্তীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে  Churnia  watch Tower এর উদ্দেশ্যে যাত্রাএই ওয়াচ টাওয়ারের তিনতলায় উঠে চারদিকের বনানী বেশ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু এক এক সময়ে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের মাথা ঘুরে যাচ্ছেপরে আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে জানতে পারলুম ঐ তৃতীয় তলাটি যে পিলারেরওপরআছে, সেটা নাকি মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে জয়ন্তী জঙ্গল থেকে ফিরে বক্সা জঙ্গল লজে আহার ও রাত্রিবাস









পরদিন সকালে আলিপুর দুয়ার জংশনে কাঞ্চনকন্যা ধরে কোলকাতা ফেরার জন্যে কিন্তু ট্রেণ বিকেলে ইতিমধ্যে কুচবিহার রাজ বাড়িটা দেখে যাওয়া যায় আমাদের তিন দিনের জন্যে ভাড়া করা গাড়ি সেখানে যাবেনা বললো, “মালিকেরঅনুমতিনেইবলে তাই অন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে কুচবিহার রাজ বাড়ি দেখতে যাওয়া খুব সুন্দর প্যালেস বিখ্যাত গায়ত্রী দেবীর বাসস্থান ছিল একসময়পশ্চিমবাংলার Heritage House  বলা হয়এখন আর কেউ থাকেনা এখানে



অতঃপর যথা সময়ে আলিপুর দুয়ারে ফিরে কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস রাতে ট্রেনের মধ্যে ঘুমাবার সময়ে রাত প্রায় বারো টা নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে গেল কিছু তরুণ অবাঙ্গালী ছেলেদের চেঁচামেচিতেতাদের ইংরেজীতে অনুরোধ করলুম আমাদের ঘুম এভাবে নষ্ট নাকরতেতারা শুনবেনাএকজন আবার ইংরেজীতেই বললো 1st class –এ যাইনি কেন ? ইত্যাদী আমার সঙ্গে ঐ রকম কথা কাটাকাটি হচ্ছে বলে ভাগ্নী জেবু এক  সময় ঘুম ছেড়ে উঠে এসে বললোআপনারা দয়া করে কিছু মনে করবেন নাওঁর ঘুমের একটু সমস্যা আছেতারপর আমি বললুম “Lack of civility at its extreme” তারপর ওরা চুপ করে গেলবাড়ি ফিরে জেবু বললোআমার ভয়কর ছিল যদি ওরা মামাকে ধরে  চলন্ত ট্রেণের বাইরে ফেলে দেয় ?”
মাঝরাতে আবার ফরাক্কা বাঁধের জল নিষ্কাশন দেখার চেষ্টা করেছি, কিছুই দেখতে পাইনি উল্টো ডাঙ্গার ওপর দিয়ে যখন ট্রেণটা আস্তে আস্তে যাচ্ছিল, তখন ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলুম প্রায় ৬০ বছর আগে কোলকাতায় হোষ্টেলে থেকে পড়ার সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে রেললাইন ধরে উল্টোডাঙ্গার কাছে এসে ২ পয়সা দিয়ে হেম নস্করের মাছের ভেড়ী দেখতে যেতুম ও একটা খাল পূবদিক থেকে এসে ওখানে শেষ হয়ে যাওয়া রাস্তার ধারে খড়ের বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সে রকম আর আছে কিনা দেখ্লুম সেখানে বসতি হয়ে সবপালটে গেছেহেম নস্করের সেই ভেড়িতেই তো Salt Lake City গড়ে উঠেছে সুতরাং সব ত পালটে যাবেই